প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট বিপদ নিয়ে আমাদের সমাজে বহু প্রশ্ন এবং ভুল বোঝাবুঝি দেখা যায়। একদিকে কেউ দাবানলকে আল্লাহর গযব হিসেবে অভিহিত করেন, আবার অন্যদিকে কেউ ভূমিকম্পকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে তুলে ধরেন। এই দ্বিধার মধ্যে কি কোনো যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে? আজকের আলোচনায় আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।
উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝা
ধরা যাক, একজন নেতা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, “ঢাকার পাশে আরেকটি ঢাকা শহর গড়ে তুলব।”
এখন, দুইজন ব্যক্তি এই বক্তব্য নিয়ে ভিন্ন অর্থে ভাবছেন:
- প্রথম ব্যক্তি: ঢাকার পাশে আরেকটি শহর হবে, এবং সেই শহরের নামও হবে “ঢাকা।”
- দ্বিতীয় ব্যক্তি: ঢাকার মতোই আরেকটি উন্নত শহর গড়ে উঠবে।
এখানে দ্বিতীয় ব্যক্তি বিষয়টি সঠিকভাবে বুঝেছেন। কিন্তু প্রথম ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুল করে বক্তব্যের অর্থ পরিবর্তন করে ফেলেছেন।
ঠিক একইভাবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং আল্লাহর পরীক্ষার বিষয়েও মানুষ ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আল্লাহর পরীক্ষা নয়। আল্লাহর পরীক্ষা হলো সেই ধরণের বিপদ, যেটা মানুষের কারণে তৈরি হয়।



ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল আল্লাহর গযব কেন?
ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলকে অনেকেই আল্লাহর গযব মনে করেন, কারণ সেখানে বছরের পর বছর ধরে এমন কিছু কর্মকাণ্ড ঘটে আসছে যা আল্লাহর নৈতিক শিক্ষার বিরোধী। উদাহরণস্বরূপ:
- পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড।
- সমাজে ধর্মহীনতার প্রসার।
- নিরীহ মানুষ এবং দেশের ওপর আক্রমণে সক্রিয় ভূমিকা।
এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তি আসে।
আফগানিস্তানের ভূমিকম্প আল্লাহর পরীক্ষা কেন?
আফগানিস্তানের মানুষ যুগের পর যুগ যুদ্ধ, দারিদ্র্য, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। তারা সবসময় আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখেছে এবং ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। তাই অনেকেই মনে করেন, তাদের ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ আসলে আল্লাহর পরীক্ষা।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর পরীক্ষা মানে এমন বিপদ, যা মানুষের সহ্যশক্তি এবং ধৈর্যের উপর নির্ভর করে।
একই বিপদ, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি: উদাহরণ
ধরা যাক, আপনার কাছে একটি মোবাইল ফোন আছে। একদিন আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ৭০ বছর বয়সী আপনার চাচা এবং ১২ বছরের আপনার ভাতিজার সঙ্গে একটি পরীক্ষা করবেন।
প্রথমে আপনি মোবাইল ফোনটি চাচার হাতে দিলেন এবং বললেন, “চাচা, আমি ইন্সটাগ্রামে একটি ছবি আপলোড করেছি। দয়া করে সেটা খুঁজে বের করুন।”
চাচা ফোনটি হাতে নিয়ে কয়েক মিনিট চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন:
“আর বলিস না, এটা একটা ঝামেলা! কোথায় কি করলি তা আমি কিভাবে খুঁজে বের করব? আমার বয়সে এসব বুঝি না। একটা চাপলে আরেকটা চলে আসে। এতো ঝামেলার জিনিস আমি বুঝতে পারি না!”
তারপর আপনি সেই একই কাজ আপনার ১২ বছরের ভাতিজার হাতে দিলেন। ভাতিজা ফোন হাতে নিয়ে কয়েক মিনিট চেষ্টা করল এবং বলল:
“দেখি, আমি চেষ্টা করছি। হয়তো একটু সময় লাগবে। আরেকটু সময় পেলে আমি ঠিক খুঁজে পাব।”
এরপর, এক ঘণ্টা পরে আপনি চাচা এবং ভাতিজা উভয়ের সঙ্গে কথা বললেন এবং একই প্রশ্ন করলেন, “মোবাইল ফোনে কি করতে বলেছিলাম?”
- চাচা: “এটা একদম ঝামেলা! কোথায় কি খুঁজে পাবে, আমি বুঝতেই পারলাম না। আমার বয়সে এসব কাজ করা সম্ভব নয়।”
- ভাতিজা: “আমাকে পরীক্ষা করার জন্য বলেছিলে। আমি চেষ্টা করেছি, একটু সময় বেশি পেলে হয়তো পারতাম।”
এখানে দেখা যাচ্ছে, একই কাজ দুইজনের কাছে দুইভাবে ব্যাখ্যা হয়েছে।
- চাচার কাছে এটি ঝামেলা এবং বিপদ।
- ভাতিজার কাছে এটি পরীক্ষা এবং শেখার একটি সুযোগ।



মানবসৃষ্ট বিপদের বাস্তব উদাহরণ
ধরা যাক, একটি এলাকায় সরকার বনভূমি উজাড় করে সেখানে একটি কারখানা স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নিল।
কারখানা গড়ে তোলার জন্য অগণিত গাছ কেটে ফেলা হলো, আর এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল। কয়েক বছর পর, ওই এলাকাটি ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হলো। গ্রাম এবং শহরের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেল। মানুষ জানমালের ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হলো।
এখন এই বন্যা সম্পর্কে দুই ধরনের মতামত সামনে আসলো:
- ধর্মীয় বিশ্বাসী লোকেরা বলল: এটি আল্লাহর গযব। মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করেছে, তাই আল্লাহ তাদের এই শাস্তি দিয়েছেন।
- পরিবেশবিদরা বললেন: এটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। গাছ কেটে ফেলার ফলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। গাছের শেকড় মাটির পানি ধরে রাখতে পারত। কিন্তু বনভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে মাটি নরম হয়ে গেছে এবং বন্যা হয়েছে।
এখানে বোঝা যাচ্ছে, এই বিপদ আল্লাহর গযব নয়; এটি মানুষের নিজের ভুলের ফলাফল।
এমন উদাহরণ আমাদের শিক্ষা দেয় যে প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট না করে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
ধর্মীয় শিক্ষা এবং আমাদের করণীয়
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সবসময় গযব মনে করা উচিত নয়। কারণ অনেক সময় তা আমাদের কর্মকাণ্ডের ফল।
২. বিপদকে আল্লাহর পরীক্ষা হিসেবে মেনে নিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
৩. পরিবেশ এবং সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
উপসংহার
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আল্লাহর পরীক্ষা নয়। আল্লাহর পরীক্ষা হলো সেই ধরণের বিপদ, যেটা মানুষের কারণে তৈরি হয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল যদি মানবসৃষ্ট পাপের ফল হয়, তবে আফগানিস্তানের ভূমিকম্প একটি পরীক্ষার অংশ। আমাদের উচিত এই পার্থক্যগুলো বুঝে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করা এবং নিজের দায়িত্ব পালন করা।
সবশেষে, ছোট বড় তিনটি কথা মনে রাখতে হবে:
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আল্লাহর পরীক্ষা নয়। আল্লাহর পরীক্ষা হলো সেই ধরণের বিপদ, যেটা মানুষের কারণে তৈরি হয়।
- আল্লাহ সবসময় বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন না, মাঝে মাঝে সম্পদ ও আনন্দ দিয়েও পরীক্ষা করেন। আপনার গ্রামে, আপনাকে সবচেয়ে ধনী বানিয়ে পরীক্ষা করেন, আপনি জনসেবা করেন কিনা।
- বর্তমান ক্যালিফোর্নিয়ায় যে দাবানল, একজন ধর্মবিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে আমার ব্যাক্তিগত মতামত হচ্ছে সেটা কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না। তাদের প্রচন্ড পাপের ফল। তাদের অভিশাপ।
- যুগের পর যুগ আফগান, ইরাক, ফিলিস্তিনে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দেয়ার জন্য আর্থিক ও মৌখিকভাবে সহযোগিতা করে আসা জাতির এমন দূর্যোগে আনন্দ অনুভব করা উচ্ছ্বাস করা একজন মানবিক ও সুস্থ মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্মের প্রশ্ন এখানে আসেই নাই।