বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন প্রকল্প: উন্নয়ন না দুর্নীতি?

Md Rafiqul Islam

Updated on:

rail engine project investigation bangladesh

রেলের ৭০ ইঞ্জিন প্রকল্পে কোরিয়ান চুক্তি: উন্নয়ন নাকি দুর্নীতি?

বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ক্রয় করা মিটারগেজ এমজি (MG) ইঞ্জিন নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। সরকারি প্রতিবেদন বলছে, এই প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত আগ্রহে রেল খাতের উন্নয়নের মাইলফলক। তবে অন্যদিকে, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহাবুব কবির মিলনের ফেসবুক পোস্টে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ—এই ইঞ্জিনগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের এবং এর পেছনে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট ও বড় ধরনের দুর্নীতি।

সরকারি অবস্থান: উন্নয়নের ধারাবাহিকতা

রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেলপথ উন্নয়নে ৭০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনা হবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। এর জন্য কোরিয়ার একটি কোম্পানি ১.৬০% সুদে প্রায় ২ হাজার ৬৮০ কোটি টাকার ঋণ দিচ্ছে। এর আগে পূর্বাঞ্চলে ৩০টি MG ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ায় পুরনো ট্রেনগুলোতে গতি ফেরে এবং যাত্রীসেবায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

প্রকল্পটি ২০১১ সালে একনেকে অনুমোদন পায় এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমা বাড়িয়ে নতুন পরিকল্পনায় এগোচ্ছে। সূত্র বলছে, রেলওয়ের প্রায় ৯০% ইঞ্জিনই আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে; কিছু রেল ইঞ্জিন ৩০ বছর ধরে চলায় বিকল হচ্ছে মাঝপথে। নতুন রেল ইঞ্জিন প্রকল্প এসব সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।

rail engine project investigation bangladesh

মাহাবুব কবির মিলনের অভিযোগ: কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি ও গায়েব তদন্ত

সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহাবুব কবির মিলনের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁর দাবি, দুই বছর আগে হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে আনা ৩০টি MG ইঞ্জিন এখন প্রায় অকেজো। প্রায় প্রতিদিনই দু-একটি ইঞ্জিন পথে বিকল হচ্ছে। এই ইঞ্জিনগুলো কিনতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। মিলনের ভাষ্য অনুযায়ী, “চো*** কোলাবরেটরদের যোগসাজশে অত্যন্ত নিম্নমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে রেলের চুক্তি ভঙ্গ করেছে কোরিয়ান কোম্পানিটি।”

তিনি আরও বলেন, যারা এই চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তারা অবসরে গিয়ে এখন সেই সাপ্লায়ার কোম্পানিতেই উচ্চ বেতনে চাকরি পেয়েছেন। তিনি নিজে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সব তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন, তদন্ত শুরু হলেও “তৎকালীন রেলমন্ত্রীর আশীর্বাদে” তদন্ত গায়েব হয়ে যায় বলে তাঁর অভিযোগ।

বর্তমান দুদকও বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামলেও প্রকৃত তথ্য যাচাই না করেই রেলের পক্ষের বক্তব্যকে বিশ্বাস করছে বলে অভিযোগ করেন মিলন।

দুই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ব্যবধান

বিষয়সরকারি প্রতিবেদনমাহাবুব কবির মিলনের অভিযোগ
প্রকল্পের মূল্যায়নউন্নয়নমূলক ও জরুরিসিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্প
ইঞ্জিনের মানউন্নত ও কার্যকরনিম্নমানের, প্রায় সব অকেজো
আর্থিক দিককোরিয়া থেকে সহজ শর্তে ঋণ১ হাজার কোটি টাকা অপচয়
দায়িত্বশীলতাপ্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নজরদারিতেসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অবসরে গিয়ে সুবিধা নিয়েছেন
দুদকের ভূমিকাউল্লিখিত নয়তদন্ত শুরু হলেও চাপে বন্ধ

কোরিয়ান কোম্পানি রোটেম নিয়ে দ্বিমত

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রোটেম কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিতে একবারই এজেন্সি ফি দিয়ে ১৯ বছরে ইঞ্জিন সরবরাহের কথা রয়েছে। এটি ব্যয়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী মনে করা হলেও মিলনের বক্তব্য অনুযায়ী, রোটেম অতীতে চুক্তিভঙ্গ করে নিম্নমানের ইঞ্জিন দিয়েছে। এই কোম্পানির সঙ্গে আবার চুক্তির পেছনে ‘চক্র’ সক্রিয় রয়েছে বলেও তাঁর আশঙ্কা।

রেলের ভবিষ্যৎ: উন্নয়ন না ব্যর্থতা?

বাংলাদেশের রেল খাত দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবারও নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে। তবে এই বিনিয়োগ যদি মানহীন হয়ে ওঠে কিংবা প্রকৃত তদন্ত না হয়, তাহলে উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পরিণত হতে পারে।

উপসংহার

প্রকল্প বড় হোক বা ছোট—স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে জনগণের অর্থ নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে। মাহাবুব কবির মিলনের অভিযোগ যেমন তদন্ত দাবি করে, তেমনি সরকারি সফলতার দাবিও নিরপেক্ষভাবে যাচাই জরুরি। দুই পক্ষের বক্তব্য ও বাস্তবচিত্র বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে তবেই সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব।

Leave a Comment